মানিকগঞ্জ জেলা প্রতিনিধি: বর্তমানে সরকার কৃষি অধিদপ্তরের মাধ্যমে যেখানে প্রচুর পরিমাণে ভর্তুকি দিয়ে কৃষি কাজে আগ্রহ বাড়াতে কাজ শুরু করছে এবং কৃষকদের বিভিন্ন প্রণোদনা দিচ্ছে ঠিক এমন সময় আব্দুল কুদ্দুস ডাকনাম (কুদ্দুস কোম্পানি) শ্রেণির অসাধু মাটি খেকো (ব্যবসায়ী) নানাভাবে জমির মালিকদের ভুল বুঝিয়ে কৃষি জমি থেকে মাটি কেটে নিয়ে যাচ্ছে। এতে করে সিংগাইরে কৃষি জমির পরিমাণ কমে আসছে। তাকে নিয়ে জেলা ও উপজেলার সংবাদকর্মীদের বিভিন্ন সময় সংবাদ প্রকাশেও সুফল মিলছে না।
প্রকাশ্যে দিন- দুপুরে কৃষি জমির মাটি লুট করছে অথচ প্রশাসনের লোকজন দেখেও না দেখার ভাণ ধরে আছে অদৃশ্য কারনে। এ যেন দেখার কেউ নেই।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের কৃষিজমি সংরক্ষণ নীতিমালা থাকলেও দায়িত্বশীলদের বস্তবায়নে যথেষ্ট উদাসিনতা দেখা যায়। সিংগাইর ও তার ব্যতিক্রম নয়। উপজেলার একাধিক জায়গায় অতি মুনাফা খোর দালালদের দৌরাত্ম্যে উর্বর কৃষি জমি নষ্ট করে দেদার্সে মাটি নিয়ে যাচ্ছে সিংগাইরের বিভিন্ন ইটভাটায়।এমন অবস্থায় ভবিষ্যৎ কৃষি আবাদের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ না হওয়া, জলাবদ্ধতার দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা আর বাড়িঘর-রাস্তাঘাট ধ্বংসসহ নানা ক্ষতির শঙ্কায় দিন কাটছে উপজেলার খোলাপাড়ার গ্রামের স্থানীয়দের।
কৃষি জমির মাটি লুট করার ফলে উপজেলা কৃষি বিভাগ ধান চাষে লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ব্যর্থ হচ্ছে অনেক ক্ষেত্রে। দুষিত হচ্ছে পরিবেশ। লাভবান হচ্ছে মধ্যসত্বভোগি। অপরিকল্পিত ভাবে মাটি ও বালু পরিবহনে সাধারণ মানুষ ভোগান্তির স্বীকার হচ্ছে।
মানিকগঞ্জের সিংগাইর উপজেলায় বলধারা ইউনিয়নের খোলাপাড়া এলাকার হুনাখালি চকে তিন ফসলি জমিতে গড়ে ওঠা শতাধিক ইটভাটায় বিক্রি করা হচ্ছে ফসলি জমির মাটি। এতে দিনদিন কমছে চাষাবাদের জমি। ফলে হ্রাস পাচ্ছে ফসল উৎপাদন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এ উপজেলায় একের পর এক গড়ে ওঠা ইটভাটা গ্রাস করে নিয়েছে ফসলি জমি। নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করে দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের ম্যানেজ করে গড়ে ওঠা বৈধ-অবৈধ ইটভাটাগুলো কৃষকদের গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে।স্থানীয় প্রশাসনকে বৃদ্ধা আঙুল দেখিয়ে খননকৃত মাটি ইটভাটাসহ বিভিন্ন ব্যক্তির কাছে কুদ্দুস নামের জনৈক ব্যক্তি মাটি বিক্রি করে বলে অভিযোগ স্থানীয়দের।
সরেজমিনে দেখা যায়, উপজেলার বলধারা ইউনিয়নের খোলাপাড়া গ্রামের প্রবেশ মুখে একটি ইটভাটা। এমএসবি নামের ইটভাটার চারপাশে কৃষি জমি। ভাটা লাগোয়া জমিতে মজুদ করা লাখ লাখ ইটের পাহাড়। পাশেই ফসলি জমি থেকে কেটে আনা মাটির পাহাড়। দানবাকৃতির তিনটি ভেকু দিয়ে কাটা হচ্ছে কৃষি জমির মাটি। উর্বর ৩ ফসলী কৃষি জমি কেটে করা হচ্ছে বড় বড় পুকুর। সরকারি আদেশ নির্দেশ অমান্য করেই চলছে উৎসবমুখর মাটি লুট।ফসলি জমির মাটি ভেকু দিয়ে কেটে ট্রলি ও ড্রাম ট্রাকে ভরা হচ্ছে। ট্রলি ও ড্রাম ট্রাকে মাটি নেওয়ার কারণে গ্রামীণ কাঁচা ও পাকা রাস্তাগুলো ভেঙে দেবে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ধুলোয় নষ্ট হচ্ছে রাস্তার পাশে বাড়িগুলো।
চলতি মৌসুমে এ জায়গা থেকেই পুরো উপজেলায় ভাটার আশপাশে চলছে মাটি বিক্রির মহোৎসব। মাটি খেকো কুদ্দুসের খপ্পরে পড়ে জমির টপ সয়েল যাচ্ছে ইটভাটায়, পুড়ছে আগুনে। ফলে উজাড় হচ্ছে কৃষি জমি।
জমির মালিকদের মামলা-হামলার ভয় দেখিয়ে ভীত সন্তস্র করে বহাল তবিয়তে অবৈধভাবে ইটভাটা চালিয়ে যাচ্ছে। গ্রামবাসি প্রতিবাদ করতে গেলে প্রশাসন দিয়ে উঠিয়ে নিয়ে গুম করার হুমকি ধামকির ভয়ে কেউ কথা বলতে চায় না ।
দৈনিক সংবাদ সারাবেলার এই প্রতিবেদকের উপস্থিতিতে খোলাপাড়া গ্রামে ক্ষতিগ্রস্থ কৃষক জড়ো হন। তবে তারা কথা বলতে চান না। এর কারণ হিসেবে তারা জানিয়েছেন যে সংবাদপত্রে নাম প্রকাশ হলেই পরদিন হুমকি-ধামকি দিয়ে গ্রামছাড়া করবে প্রভাবশালীরা।
ইটভাটার কারণে এখন আগের মতো ফসল হয় না। ধান চাষের খরচই ওঠে না। অথচ আগে এসব জমিতে কখনও কখনও তিন ফসল, কখনও কখনও চার ফসল পেতাম। এখন জমির উপরিভাগ সমান মাটি নেই। স্থানে স্থানে গর্ত। তাই চাষাবাদ করা যায় না। এমনকি জমির মাটি কেটে নিয়ে যাওয়ার জন্য ট্রাক চলাচলের কারণেও বহু জমি নষ্ট হয়ে গেছে। এসব জমি মাটি ট্রাকের চাকার কারণে শক্ত হয়ে যাওয়া ফসল হয় না।
স্থানীয়রা আরও অনেকে জানায়, দিনরাত বাধাহীন এভাবেই মাটি কাটে ইটভাটার মালিকেরা। অপরিকল্পিতভাবে মাটি কাটায় ভয়াবহ বিপর্যয়ের সম্মুখীন হচ্ছে পরিবেশ। মাটিতে যে জিপসাম বা দস্তা থাকে তা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এতে মাটির জৈব শক্তি কমে গিয়ে দীর্ঘমেয়াদী মাটি পরিবহনকারী ট্রলি ও ট্রাকগুলো যেনতেনভাবে মাটি ভর্তি করে মহাসড়ক ও ইউপির গ্রামীণ কাচা-পাকা রাস্তাগুলোতে চলাচল করায়, মাটি পড়ে রাস্তার ভিটুমিন নষ্ট ও রাস্তা দেবে গিয়ে জনপথের মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে।
ইটভাটার দালালরা মূলত কৃষকদের বিভিন্নভাবে ফুসলিয়ে বা ভুল বুঝিয়ে জমির মাটি স্বল্প মূল্যে খরিদ করে তা বিক্রি করছে ভাটা মালিকদের কাছে। এতে লাভবান হচ্ছে ইটভাটার মালিকসহ একটি দালাল চক্র।
ইটভাটার কারণে এক দিকে ক্ষতি হচ্ছে ফসলী জমির। অপরদিকে পরিবেশের। রাস্তার পাশের বাড়িগুলো ধোলায় ভর্তি থাকে সব সময়। ভাটার পাশে কোন গাছপালার ফলও ধরে না। মানুষের বিভিন্ন ধরনের রোগভালাই বেঁকে বসেছে দূষিত পরিবেশের জন্য । স্কুল, কলেজের সাথে ইট ভাটা গড়ে উঠার কারণে স্কুলে ছাত্র-ছাত্রীদের বিভিন্ন ধরনের হাঁচি কাশি জনিত রোগ ব্যধিত লেগেই থাকে।
ইট ভাটার ট্রাক রাস্তার পাশ দিয়ে চলাচলের কারণে মাটির ট্রাক থেকে মাটি পড়ে রাস্তা ধুলায় একাকার হয়ে যায়। জনজীবন হয়ে পড়ে বিপন্ন। সেই কারণে রাস্তা দিয়ে মানুষ চলাচল করতে গেলে ধুলো দিয়ে সারা শরীর ডেকে যায়।
শুধু ফসলি জমিই নষ্ট নয়, এসব ইটের ভাটায় মাটি আনা নেওয়ায় ব্যবহৃত ট্রাক্টরের বেপরোয়া চলাচলে এলাকার গ্রামীণ সড়কগুলো পরিনত হয়েছে খানাখন্দে, দুলাবালিতে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে এখানকার সাধারণ মানুষ।সরকারী আইন অনুযায়ী কৃষি জমির মাটি ভাটায় ব্যবহার নিষিদ্ধ।
ফসলি জমির মাটি বিক্রি করে বাড়তি কিছু অর্থ পাওয়ার বিপজ্জনক ভাবনা থেকে সিংগাইরের খোলাপাড়ায় ফসলি জমি থেকে দেদার মাটি বিক্রি করছে এক শ্রেণির কৃষক। কৃষকদের অর্থের লোভ দেখিয়ে নিজেদের ইটভাটার জন্য মাটি নিয়ে যাচ্ছেন ইটভাটার মালিকরা।
মাটি কেনাবেচায় আপাত লাভবান হলেও ক্ষতির মুখে পড়ছে জমির উর্বরতা শক্তি। এছাড়া মাটি কেটে নেওয়ার ফলে জমি নিচু হয়ে পড়ায় চাষাবাদে বিঘ্ন ঘটনার ঘটনাও ঘটছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ফসলি জমি কেটে পুকুর করার প্রতিযোগিতা। পরিনত হচ্ছে পুকুর-ডোবায়। দিন দিন ফসলের উৎপাদন কমছে, বেকার হচ্ছে কৃষক, পরিবেশ হচ্ছে দূষিত। এ অবস্থায় দিশেহারা ও অসহায় জীবন যাপন করছে এবং স্বাস্থ্য হুমকির মুখে পরছে হজার হাজার মানুষ।
আইন অনুযায়ী কোনো ইটভাটার ১ কিলোমিটারের মধ্যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কিংবা স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান থাকলে সেই ইট ভাটা বন্ধ করতে হবে। এছাড়া, ইটের কাঁচামালের জন্য ফসলি জমির মাটি ব্যবহার করা যাবে না। অথচ পাল্লি গ্রামের ১ কিলোমিটারের ভেতরে দুটি প্রাথমিক স্কুল, স্বাস্থ্য সেবার কমিউনিটি ক্লিনিক ও একটি মাদ্রাসা রয়েছে।
এতে করে মানুষের যাতায়াতে জনদুর্ভোগের শেষ নেই। গ্রামীণ পাঁকা রাস্তাগুলো হয়েছে খানাখন্দ আর কাঁচা রাস্তাগুলোতে তৈরি হয়েছে বড় বড় গর্ত আর সড়কে উড়ে বেড়াচ্ছে ধুলাবালি। একারণে অতিষ্ট হয়ে পড়েছে জনজীবন।
সরকারি গেজেটে প্রকাশিত মাটির ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ ও হ্রাসকরণ ২০১৩ সালের ৫৯ নং আইনের ৫ ধারা অনুযায়ী কোন ব্যক্তি ইট প্রস্তুত করার উদ্দেশ্যে কৃষি জমি হতে মাটি কাটা বা সংগ্রহ করে ইটের কাচাঁমাল হিসাবে ব্যবহার করতে পারবে না। যদি কোন ব্যক্তি আইনের এই ধারা লঙ্ঘন করেন তা হলে তিনি অনধিক ২ (দুই) বৎসরের কারাদণ্ড বা ২ (দুই) লক্ষ টাকা অর্থদন্ড অথবা উভয় দণ্ডেদন্ডিত হইবেন।
অন্যদিকে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর কর্তৃক নির্মিত বা ইউনিয়ন বা গ্রামীন সড়ক ব্যবহার করিয়া কোন ব্যক্তি ভারি যানবাহন দ্বারা ইট বা ইটের কাচাঁমাল পরিবহন করিতে পারিবেন না। যদি কোন ব্যক্তি আইনের এই ধারা লঙ্ঘন করেন তা হইলে তিনি ১ (এক) লক্ষ টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হইবেন। এসব আইন থাকার পরও ভূমিদস্যুরা আইনের তোয়াক্কা না করে স্থানীয় প্রশাসন চোখের সামনে এসব কর্ম চালিয়ে যাচ্ছে। বিষয়টি স্থানীয় উপজেলা প্রশাসনকে অবহিত করার পরও প্রশাসনের এই নিরব ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ করেছে এলাকাবাসীর মনে।
কৃষিবিজ্ঞান বলছে, যেকোনো ফলনযোগ্য জমির উৎপাদন শক্তি জমা থাকে মাটির ৬ থেকে ১৮ ইঞ্চি গভীরতায়। এটাই টপ সয়েল বা প্রাণমাটি; এলাকাভেদে জৈবিক প্রক্রিয়ায় টপ সয়েল তৈরিতে ১০০ থেকে ৫০০ বছর সময় লেগে যায়। মাটির এই অংশেই ফসল বেড়ে ওঠার গুণাগুণ সুরক্ষিত থাকে। বীজ প্রয়োজনীয় জীবনীশক্তি বা বাঁচার ও বিকাশের উপাদান গ্রহণ করে টপ সয়েল থেকে। এই অংশ একবার কেটে নিলে জমিতে মৃত্তিকা প্রাণ থাকে না। জমি পঙ্গু হয়ে যায়। এমন একটা মূল্যবান মাটির স্তর আমরা শেষ করে দিচ্ছি। দেশের সব কৃষিবিদ- কৃষি কর্মকর্তা বিষয়টি জানেন।
যেমন খুশি তেমন সাজো প্রতিযোগিতার মত করে তো দেশ চলতে পারে না।আইনের সঠিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দেশে কৃষি জমি রক্ষা করতে হবে ও এ বিষয়ে প্রশাসনের পক্ষ থেকে আইনের সঠিক প্রয়োগ ছাড়া ফসলি জমি রক্ষা করা সম্ভব নয় বলে মনে করছেন সচেতন মহল।
মাটি কাটা বিষয়ে জানতে বলধরা ইউনিয়নের এএবি ইটভাটা মালিক আব্দুল কুদ্দুস (কোম্পানি) কে ফোনে কল দেওয়া হলে সাংবাদিক পরিচয় শুনে কলটি কেটে দেন। একাধিক বার ফোন দিলে তিনি আর কল রিসিভ করেননি।
এ বিষয়ে সিংগাইর উপজেলা অফিসার
পলাশ কুমার বসু দৈনিক সংবাদ সারাবেলা প্রতিনিধি কে বলেন,নায়েব পাঠিয়ে খোঁজ নিচ্ছি অতি দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে।